জেলেদের ফাঁদে মরছে সামুদ্রিক পাখি


বরগুনার বিশখালী-বলেশ্বর-পায়রা এই তিন নদীর মোহনা ও বঙ্গোপসাগরে তীরবর্তী এলাকার চরের শুঁটকি পল্লিসহ জেগে ওঠা চরে ফাঁদ পেতে পাখি শিকার করছেন মৌসুমি জেলেরা। এতে অবাধে মারা পড়ছে নানা প্রজাতির সামুদ্রিক পাখি। পরিবেশ ও প্রতিবেশের সুরক্ষায় সামুদ্রিক পাখিদের অবাধ নিধন রোধ করতে আইনের প্রয়োগ জরুরি বলে মনে করছেন প্রকৃতি বিশেষজ্ঞরা। বিরল প্রজাতির পাখিদের বাঁচাতে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার দাবিও জানিয়েছেন পরিবশেবাদী সংগঠনগুলোর নেতারা।
গভীর বঙ্গোপসাগরের বুকে ‘চর বিজয়’। বর্ষা মৌসুমে পানিতে ডুবে থাকলেও শীত মৌসুমে পাঁচ হাজার একর আয়তন নিয়ে জেগে ওঠে এ চর। ইলিশসহ সামুদ্রিক মাছ আহরণের জন্য শীত মৌসুমে এখানে ও এর আশপাশে থাকে জেলেদের উপস্থিতি। অস্থায়ী বাসস্থান তৈরি করে মাছ শিকার ও শুঁটকি তৈরি করেন তারা। মানুষের বিচরণ কম থাকায় শীতে এখানে সমাগম ঘটে অতিথি পাখির।
দক্ষিণাঞ্চলের ভ্রমণ নিয়ে কাজ করেন আরিফুর রহমান। তিনি প্রায়ই পর্যটকদের নিয়ে এই চরে ভ্রমণ করেন।
আরিফুর রহমান বলেন, প্রায় শতাধিক মৌসুমি জেলে চর বিজয়ে মাছ শিকার করে শুটকি তৈরি করেন। এই জেলেরা খাদ্যান্বষণে আসা সামুদ্রিক পাখি শিকার করে। পাখি ধরার জন্য বাঁশের সঙ্গে জাল টাঙ্গিয়ে রাখেন এবং পাখিরা নিচ দিয়ে ওড়ার সময় ওই জালে আটকা পড়লে তা শিকার করে নিজেরা খাবার হিসেবে ব্যবহার করেন। বেশি পরিমাণে পাখি শিকার করতে পারলে তা ডাঙ্গায় এনে বিক্রিও করে। ওই জালে আটকা পড়ে কিছু পাখি মারাও যায়।
তিনি আরও বলেন, চর বিজয়ে গিয়ে কয়েকটি দেশি মরা পাখি পড়ে থাকতে দেখেছি। পাখিগুলো আকারে বেশ বড়। জালে আটকা পড়ে মৃত্যু হওয়ায় শিকারিরা সেগুলো চরে ফেলে রেখেছে বলে মনে হয়। এখানে পাখি নিধনে কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
একইভাবে লালদিয়ার চর, সোনাকাটা, আশার চর, দুবলাসহ সামুদ্রিক চরকে ঘিরে মৌসুমি জেলেরা মাছ শিকার করে শুটকি তৈরি করেন। সেখানে মাছ শিকারে জন্য পাখিদের আনাগোনা হয় ওইসব চরে।
আর জেলেরা জালের ফাঁদে শিকার হয় সামুদ্রিক এসব পাখি। বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার হরিণঘাটা এলাকার জেলে জেলে হেমায়েত। তিনি বঙ্গোপসাগরের মোহনায় মাছ শিকার করেন। হেমায়েত বলেন, বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী লালদিয়া চরে শুটকি তৈরি করতে আসা জেলেরা জালের ফাঁদ পেতে সামুদ্রিক পাখি শিকার করেন। এসব পাখি খাবারের সন্ধানে শুঁটকির চাতাল ও মাছ ধরার জালের কাছে ওড়াওড়ি করে। প্রতিদিনই ওরা এসব পাখি শিকার করে, পাখির মাংস রান্না করে খায়। গড়ে প্রতিদিন অর্ধশতাধিক পাখি মারা পড়ে দুবলা ও লালদিয়া এলাকায়।
তালতলী সংলগ্ন আশার চর ও সোনাকাটা এলাকার বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী চরে শীত মৌসুমে অসংখ্য সামুদ্রিক পাখির আনাগোনা হয়। সেখানেও অবাধে জেলেদের শিকারে পরিণত সামুদ্রিক পাখি। আশার চর এলাকার একজন জেলে নুরুল আমিন জানান, শুঁটকির চাতাল ও মাছ ধরার জাল তোলার সময় পাখিরা মাছ শিকারের জন্য আসে। আমরা এসব পাখিদের বালিহাঁস বলে থাকি। কিন্তু নানা প্রকার পাখি আসে যাদের নাম জানি না। এইসব পাখি জেলেদের জালে আটকেও যায় আবার ফাঁদ পেতে শিকার করা হয়। আমি বেশ কিছু পাখি শিকার করে শুঁটকির জেলদের নিয়ে যেতে দেখেছি।
কোস্টাল এনভায়রনমেন্ট প্রটেকশন নেটওয়ার্ক (সিওয়াইএন) এর সমন্বয়ক সাগর কর্মকার বলেন, দ্বীপগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করলে দেশের পর্যটনশিল্পে ঘটবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এবং রাজস্ব খাতে যোগ হবে এক নতুন মাত্রা। প্রকৃতিকে নিরবে উপভোগ করতে হয়। কিন্তু সেখানে ইঞ্জিনচালিত ট্রলার নিয়ে পর্যটকরা যান যাতে শব্দ দূষণের কারণে সেখানকার পাখিগুলোর স্বাভাবিক বিচরণ বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে সেখানে শব্দ দূষণ হয় না এমন জলযানে যাতায়াত করা যেতে পারে এবং সেখানে পর্যটন কর্তৃপক্ষ একটি বড় আকারের পন্টুন স্থাপন করতে পারে যাতে পর্যটকরা ওই চরে বিচরণ না করে পন্টুন থেকেই প্রকৃতিকে উপভোগ করতে পারে, যোগ করেন তিনি।
ওয়াইল্ড লাইফ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট নিয়ে কাজ করেন হোসাইন সোহেল।
তিনি বলেন, সামুদ্রিক পাখি হত্যা আইনে একটি অপরাধ। এজন্য আইনের প্রয়োগ জরুরি। বনবিভাগের দায়িত্ব পাখিদের সুরক্ষা দেওয়া। পাশাপাশি পরিবেশ সচেতনদের বিষয়টি নিয়ে ভাবা জরুরি। পাখি নিধন বন্ধে ক্যাম্পেইন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে জেলেদের সচেতন করতে হবে।
এ ব্যাপারে বন বিভাগের বরগুনা জেলার সহকারী বন সংরক্ষক আল মামুন বলেন, চরগুলো বিচ্ছিন্ন হওয়ায় ও সেখানে যাতায়াতে জলযান না থাকায় নজরদারি করা যাচ্ছে না। পাখি নিধনের বিষয়টি জানা নেই তবে খোঁজ নিয়ে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করা হবে।
এএজে
